একটি ৭ বছরের মেয়ে প্রতিদিন স্কুল শেষে তাকিয়ে থাকে দূর আকাশের দিকে—মা একদিন বুঝি প্লেনে করে ফিরে আসবেন। কিন্তু সেই মা হয়তো ফিরবেন না আর কখনো। কারণ, তিনি এখন বন্দি—একটি অচেনা দেশে, এক খদ্দেরের বিছানায়, নিঃস্ব, নিঃশেষ। চাকরি, ভালো জীবন আর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন—এই তিনটিই ছিল বিদেশবিভুঁইয়ে পাড়ি জমানো নারীদের চোখে। অথচ বিমানবন্দরের শেষ গেট পেরোনোর পর তাদের সামনে খুলে গেছে এক ভয়ংকর পৃথিবীর দরজা। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠানোর নাম করে সংগঠিত চক্রগুলো বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশি নারীদের পাচার করে চলেছে। তাদের হাতে থাকে বৈধ পাসপোর্ট, অথচ গন্তব্যে পৌঁছেই এসব নারী হয়ে ওঠেন বন্দি—যৌন শোষণ, ধর্ষণ আর দাসত্বের দুনিয়ায়। কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন শত শত নারীর করুণ অভিজ্ঞতা, পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা, এমনকি পাসপোর্ট নম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে মেয়ে ও নারী পাচারের এই ভয়াবহ গল্প যেন প্রতিদিনই দীর্ঘতর হচ্ছে। স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের পাঠানো হয় বৈধ ভিসা-পাসপোর্টে, কিন্তু গন্তব্য হয় এক ভয়াবহ দাসজীবন। একের পর এক বয়ানে উঠে এসেছে ধর্ষণ, নির্যাতন, পাসপোর্ট আটকে রাখার গল্প। তাদের কেউ কেউ কফিনে করে ফিরে আসে, কেউ নিখোঁজ, আর কারও খোঁজ কেউ কখনো নেয়নি। নারী পাচারে দেশের মধ্যেই কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের খোঁজ পেয়েছে কালবেলা। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের শাহিন আলম এবং তার ছেলে নাহিদ হাসান লিমন দিনে দিনে কবজায় নিয়েছেন পুরো পাচার-বাণিজ্য। এর সঙ্গে টাকার বিনিময়ে কুকর্মে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট, বিএমইটি এবং পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
রাজধানীর উপকণ্ঠ একটি শহরে শিল্পকারখানায় কাজ করতেন ফাতেমা বেগম (ছদ্মনাম)। পেটের তাগিদে ২০০ কিলোমিটার দূরের এক শহর থেকে চাকরির খোঁজে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী শহরে আসেন ওই নারী। কলকারখানায় কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা গ্রামের থাকা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য পাঠাতেন। কষ্ট হলেও ভালোই চলছিল। তবে মো. সাইফুল্লাহ নামে এক মানব পাচারকারীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে ওলট-পালট হয়ে যায় ফাতেমার জীবন। কাছাকাছি থাকায় তাদের মধ্যে একসময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর সেই সম্পর্কে গড়ায় বিয়েতে। বিয়ের পরই ফাতেমার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। দুজনের একসঙ্গের বিশেষ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীই ব্ল্যাকমেইল করেন ফাতেমাকে। বাধ্য করেন অসামাজিক কাজ করতে। স্বামী নিজেই ফাতেমাকে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল আর খদ্দেরদের বাসাবাড়িতে দিয়ে আসতেন রাত কাটাতে। এভাবে চলে ৪ বছর। এরপর এই অসামাজিক কাজে অভ্যস্ত হলে তাকে চেষ্টা করা হয়ে ভারতে পাচারের। তবে বর্ডার এলাকা থেকে পালিয়ে আসেন ফাতেমা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চক্রে একদম প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করেন নারীরা। তারা প্রথমে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ-সরল, অভাগগ্রস্ত পরিবারকে টার্গেট করে। এরপর সেসব পরিবারের মেয়ে-কিশোরীদের বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেয়। অভাব-অনটন আর দুর্দশা কাটিয়ে একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখায়। এসব নারীকে বলা হয় অ্যারেঞ্জার। এই অ্যারেঞ্জারদের ফাঁদে একবার পা দিলেই সর্বনাশ। যারাই পা দিয়েছেন তারাই পরিবার, সমাজ, আত্মসম্মান, সম্ভ্রম সব হারিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। গৃহকর্মী কিংবা গার্মেন্টসে চাকরির কথা বলে এসব নারীকে ট্যুরিস্ট ভিসায় স্ত্রী সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুবাই, মালয়েশিয়া, সৌদি
আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এরপর তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন ডান্স বার, স্পা সেন্টারে। বাধ্য করা হয় অসামাজিক কার্যকলাপে। কেউ কথা না শুনলে তার ওপরে নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। এই জালে একবার জড়িয়ে গেলে তার ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের টার্গেট করে চক্রের পুরুষ সদস্যদের ভুয়া স্বামী দেখিয়ে বানানো হয় পাসপোর্ট। এরপর পুরুষ সদস্যরা ভ্রমণ ভিসায় টার্গেট নারীদের স্ত্রী দেখিয়ে পার করেন ইমিগ্রেশন। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ম্যানেজের দায়িত্ব পালন করেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার গোয়ালদী চর এলাকা আব্দুল গণি। তবে পাসপোর্টসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে তার নাম তরিকুল ইসলাম, আল আমিন, ডালিম কিংবা ওসমান গণি। এই ব্যক্তির একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি দৈনিক কালবেলায় ‘সবার চোখ ফাঁকি দেন বহুমুখী জালিয়াত গণি, মালয়েশিয়ায় প্রবাসীরা প্রতারণার শিকার’ শিরোনামে এই গণির বহুমুখী প্রতারণা নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরপর দেশের বাইরে নিয়ে এসব নারীকে তুলে দেওয়া হয় চক্রের অন্য সদস্যদের হাতে। তারা এই নারীদের নিয়ে আটকে রাখেন। প্রথমে আপসে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের প্রস্তাব দেন। এরপর তাতে রাজি না হলে করেন নির্যাতন। তাতেও কাজ না হলে এসব নারীকে করা হয় ধর্ষণ। সেসব ধর্ষণের ভিডিও করেন চক্রের অন্য সদস্যরা। পরে এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে করা হয় ব্ল্যাকমেইল। লোকলজ্জার ভয়ে তখন এই নারীরা বিভিন্ন অসামাজিক কাজে রাজি হন।
স্ত্রী বানিয়ে পাচার: নারী পাচার চক্রের দালালদের মধ্যে অন্যতম সোনারগাঁ এলাকার শাহিন আলম ও তার ছেলে মো. নাহিদ হাসান লিমন। মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারের অন্যতম প্রধান হোতা বাপ-ছেলের এই সিন্ডিকেট। বাবা-ছেলের এই চক্রে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করেন বিভিন্ন নারী দালাল বা অ্যারেঞ্জাররা। নারীপ্রতি এই অ্যারেঞ্জাররা পান ১ লাখ টাকা করে। তবে সুন্দরী ও অল্প বয়সের কিশোরী হলে রেট আরও বেশি পান। এই বাবা-ছেলের পাচার করা একাধিক নারীর পাসপোর্ট এসেছে কালবেলার হাতে। এসব পাসপোর্টে স্বামীর জায়গায় কোথাও শাহিন আলম, আবার কোথায় তার ছেল লিমনের নাম লেখা। বিদেশে পাচার হওয়া নারীরাও ছবি দেখে শাহিন ও লিমনের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন কালবেলাকে। পাচার হওয়া নারীদের মধ্যে একজন শান্তা। পিতার নাম মো. শাহজাহান মোল্লা। পাসপোর্ট নম্বর: ইএ০৩৭১১১৬ ও ব্যক্তিগত পরিচিত নং ৫১০০৬২৪৭২৪। এই নারীকে নিজের স্ত্রী দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন মো. শাহিন আলম। নারায়ণগঞ্জে বাড়ি হলেও এই পাসপোর্টে শাহিন আলম তার ঠিকানা দিয়েছেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর। তবে পাসপোর্টের ইমার্জেন্সি কন্ট্রাকে দেওয়া নম্বরে ফোন দিলে তারা এই নামে কাউকে চেনেন না বলে জানান কালবেলাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফাঁদে পড়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়া এই নারী এখন নিজেই হয়ে উঠেছেন অসামাজিক কার্যকলাপ জগতের এক সম্রাজ্ঞী। এ ছাড়া নিজের স্ত্রী বানিয়ে লামিয়া আক্তার (ছদ্মনাম) নামে আরও এক নারীকে পাচার করেছেন শাহিন আলম। যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৭৪৬৯৪৯৭ ও ব্যক্তিগত পরিচিতি নম্বর ২৮২১৪২৯৫৭৪। ওই নারীর একটি পুরোনো পাসপোর্ট রয়েছে, যার নম্বর ইএইচ০০৫৩৩১২। এই পাসপোর্ট দিয়ে তিনি ২০২২ সালে একবার ওমান গিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ জানুয়ারি ভিসা নম্বর ৪০৪৫৩৮৮-এর বিপরীতে তিনি বিএমইটির ছারপত্র পান। জানতে চাইলে এই নারী কালবেলাকে বলেন, ‘রেখা নামে এক অ্যারেঞ্জারের সঙ্গে আমার ২ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। আমাকে বিদেশে এনে গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা ছিল ৭০ হাজার টাকা বেতনে। শাহিন ভাই আমাকে তার স্ত্রী সাজিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে আসে। বিমানবন্দর থেকে হৃদয় নামে একজন আমাকে তার কাছ থেকে নিয়ে যায়। আমাকে কাজ দেওয়ার কথা বলে আটকে রেখে খারাপ কাজ করতে বলে। আমি রাজি না হওয়ার মারধর করা হয়। পরে বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা পাঠায়। আমি ওই টাকা দিয়ে ওখান থেকে ছাড়া পাই। এই নারী আরও বলেন, ‘গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তারা বিভিন্ন প্রলোভনে মেয়েদের সংগ্রহ করে। এরপর শাহিন তাদের স্ত্রী সাজিয়ে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে এনে বিক্রি করে দেয়। পরে তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। আঁখি আক্তার (ছদ্মনাম) নামে আরও এক নারীকে একই শাহিন আলম স্ত্রী বানিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন। যেই নারীর পাসপোর্ট নম্বর এ১৬২৮০৯০৬। এই নারী ২৫ দিনের মতো মালয়েশিয়ায় ছিলেন। এরপর প্রবাসীদের একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। সাদিয়া আক্তার (ছদ্মনাম) নামে নারীকে স্ত্রী বানিয়ে পাচার করেছেন শাহিন আলম। যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৩৭৫৬৪০৭। সাদিয়ার পাসপোর্টের আবেদনপত্রে তার স্বামীর নাম লেখা মো. জাহিদুল ইসলাম। তবে পাসপোর্টে জাহিদুল ইসলামকে ভাই ও শাহিন আলমকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সামিয়া পারভীন (ছদ্মনাম), যার পাসপোর্ট নম্বর এ০৮৩৩৩৪৬৩। এই নারীকেও স্ত্রী দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন শাহিন আলম। নড়াইলের এই নারী ৪ লাখ টাকার মাধ্যমে স্ত্রী সেজে শাহিন আলমের সঙ্গে বিদেশে গিয়েছিলেন বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন। তবে শাহিন আলমের আসল স্ত্রী নাজমা বেগম নামে এক নারী। ছেলে লিমন ও স্বামী শাহিনের ক্যাশিয়ার নাজমা বেগম। বিভিন্ন নারীকে পাচারের টাকা-পয়সা লেনদেন করেন নাজমা।
কালবেলার হাতে শাহিন আলমের দুটি পাসপোর্ট রয়েছে। একটি পাসপোর্টের নম্বর এ০৩৬৬৮৭০০ ও এ১৩৪২২৯৯৪। এ ছাড়া শাহিন আলমের ছেলে মো. নাহিদ হাসান লিমন বাবার মতোই একই কায়দায় বিদেশে নারী পাচার করেন। মো. নাহিদ হাসান লিমনের পাসপোর্ট নম্বর এ০৪০৯১৫৯৫। তার ব্যক্তিগত পরিচিতি নম্বর ৪৬৬৫৪৯৯০০২। বর্তমানে লিমন নারীদের স্ত্রী সাজিয়ে থাইল্যান্ডে নিয়ে তারপর সেখান থেকে বর্ডার দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করেন। এ ছাড়া থাইল্যান্ড ও দুবাইয়ের বিভিন্ন ডান্স বার ও স্পা সেন্টারে নিয়মিত নারীদের বিক্রি করেন নাহিদ। সীমা (ছদ্মনাম) নামে এক নারীকে গত বছর বিদেশে পাচার করেছেন নাহিদ হাসান। ওই নারীর জন্ম ২০০৩ সালের আগস্টে। পাসপোর্ট নম্বর এ১৩৭৯৯০৩৮। সিরাজদীখানের ওই নারীর ব্যক্তিগত নম্বর ৩৩০৮৬৫৩৪৭০। শরিফা আক্তার (ছদ্মনাম) নামে আরও এক নারীকে লিমন স্ত্রী বানিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। ওই নারীর পাসপোর্ট নম্বর এ০৬১৩৫৮৫০। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত পরিচিতি নম্বর ২০০৩২৬৯২৫১৪৬৭৩৬৫৪। শাহিন ও লিমন চক্রে বিমানবন্দর পার করতে কাজ করেন আরও কয়েকজন দালাল। তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. আজিজুর রহমান নামে আরও একজন। আজিজ স্ত্রীর সাজিয়ে পার করেছেন এমন কয়েকজন নারীর পাসপোর্ট নম্বর হলো এ১১৪০৯১৪১, এ০৪০২৬৪১০, ইএল০১৮৬৮৩২, বিপি০৯৮০৭৪২। এ ছাড়া পাচার হওয়া ভুক্তভোগীরা কালবেলাকে জানিয়েছেন, বাপ-ছেলে ও নাজমার এই চক্র শত শত নারীকে এভাবে স্ত্রী সাজিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।
সন্তান জিম্মি করে মাকে পাচার, বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েও সাড়া মেলেনি: জিম্মিদশা থেকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বেশ কয়েকটি দপ্তরে কুরিয়ারের মাধ্যমে চিঠি পাঠান সোনিয়া আক্তার নামে এক নারী। অনুসন্ধানে একটি সূত্র থেকে সেই চিঠি কালবেলার হাতে এসেছে। চিঠিতে দুই সন্তানের জননী ওই বিধবা নারী লিখেছেন, ঈগলু আইসক্রিমে চাকরিকালীন শীত মৌসুম চলে আসায় কর্মী ছাঁটাইয়ে বাদ পড়ি। এ সময় শাহিনের স্ত্রী নাজমা ও মালয়েশিয়ায় থাকা শারমিন আমাকে গার্মেন্টসে ৭০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখায়। তবে মালয়েশিয়ায় যেতে তারা আড়াই লাখ টাকা দাবি করেন। পরে আমি ধার-দেনা করে দেড় লাখ টাকা দিই। পরে তারা পাসপোর্ট করে ভিসা বের করেন। পরে আমি জানতে পারি, আমাকে অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে স্ত্রী সাজিয়ে ভ্রমণ ভিসায় মালয়েশিয়া পাচার করা হবে। আমি বৈধ ভিসা ছাড়া যেতে না চাইলে আমাকে নানা হুমকি-ধমকি দেয় এবং ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে। আমাকে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় নিতে ওই টাকা তারা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঘুষ হিসেবে দিয়েছেন বলে জানান। আমাকে ৮ থেকে ১০ জনের একটি গ্রুপের সঙ্গে মালয়েশিয়া পাচারের চেষ্টা করেন তারা। যাদের সবাইকে বিভিন্ন পুরুষের স্ত্রী দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় নেওয়া হচ্ছে। পরে আমি জানতে পারি, তারা একটি শক্তিশালী মানব পাচার চক্রের সদস্য। তাদের মালয়েশিয়ার এজেন্ট শারমিন, যার মোবাইল নম্বর ৬০১৭৪৬৯৯৩০৮-এর মাধ্যমে আমাদের সবাইকে দিয়ে দেহব্যবসা করাবে। এই চক্রটি মালয়েশিয়া, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে শত শত মেয়ে পাঠিয়ে এই ব্যবসা করছে। লিখিত অভিযোগে ওই নারী আরও বলেন, ‘আমি নিরুপায় হয়ে আমার ও আমার দুই শিশুসন্তানের জীবন বাঁচানোর তাগিদে আইনি সহায়তা চাইছি।’ অনুসন্ধানে মালয়েশিয়া সূত্র থেকে সোনিয়া নামে ওই নারীর একটি ছবি এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে ওই নারীকে মালয়েশিয়ার এজেন্ট শারমিনের সঙ্গে দেখা গেছে। যার দ্বারা অনুমান করা যায়, ওই নারীকেও মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়েছে।
দুই মাস আটকে রেখে ধর্ষণ, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয় বিশেষ অঙ্গে; মামলা হয় মানব পাচার আইনে: থাকা-খাওয়া ও মাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে বাসার কাজ নেন স্বামী পরিত্যক্ত ফরিদা আক্তার (ছদ্মনাম)। শনির আখড়া এলাকার ওই বাসায় ৬ বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে সপ্তাহখানেক ভালোই কাটে। তবে এরপরই সন্তানকে জিম্মি করে বাধ্য করা হয় অসামাজিক কার্যকলাপে। কথা না শুনলে চলে মারধর, খাওয়ানো হয় বিভিন্ন মাদক। এভাবেই চলে প্রায় দুই মাস। এরপর জানালা দিয়ে ডাক-চিৎকার দিলে পাশের বাড়ির লোকজন জড়ো হয়ে উদ্ধার করেন ফরিদাকে। গত ১০ মে দুপুরে ওই নারী রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় যান অভিযোগ নিয়ে। তবে সেখানে মহিলা পুলিশ দিয়ে তাকে কয়েক ধাপে পরীক্ষা করা হয়। ওই নারীর সারা শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেখে মহিলা পুলিশ পরিস্থিতি গুরুতর বলে জানান। সেই রাতেই ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে একজনকে আটকও করে পুলিশ। তবে এর পরই পাল্টে যেতে থাকে চিত্র। ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করে কালবেলাকে বলেন, ‘ওসি স্যার থানার মধ্যে আসামিদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন। আসামিরা থানার ভেতরে এসে আমাকে হুমকি-ধমকি দেয়। পুলিশও হুমকি দেয়। পরে আমার অভিযোগ বাদ দিয়ে তারা নিজেরা অভিযোগ লিখে মাত্র ৩ জনকে আসামি করে একটা মানব পাচার আইনে মামলা নেয়। সেখানে আমাকে বানানো হয় দেহব্যবসায়ী। অথচ আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি।’ এ ঘটনায় মানব পাচার আইনের ১২ ও ১৩ দ্বারায় একটি মামলা করে পুলিশ। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমান।
সরেজমিন শনির আখড়ার সেই বাসায় গিয়েও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। পাশের ফ্ল্যাটে থাকা বাড়িওয়ালার ছেলে বাবু ও তার স্ত্রী ওই নারীকে মারধরের বিষয়টি স্বীকার করেন কালবেলার কাছে। গত মঙ্গলবার ১৩ মে এ বিষয়ে জানতে যাওয়া হয় ডিএমপির ওয়ারী বিভাগে উপকমিশনারে কার্যালয়ে। সেখানে গিয়ে উপকমিশনার হারুণ অর রশিদকে পাওয়া গেলেও তিনি অসুস্থ জানিয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালে অভিযোগ জানিয়ে ভুক্তভোগী এক নারী পুলিশের চক্করে হয়ে যান দেহব্যবসায়ী। ওই নারীর নাম সুমাইয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে জানান, শাহিন সিন্ডিকেটের বিল্লাল নামে এক দালালের মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়া যেতে ৩ লাখ টাকা জমা দেন। তাকে গার্মেন্টস ভিসার কথা বলে স্ত্রী সাজিয়ে পাচার করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে বিষয়টি জানতেন না ওই নারী। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা ওই নারীকে তার স্বামী কে—জিজ্ঞাসা করলে বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই নারী জানান, তিনি অবিবাহিত। তখন পেছন থেকে এক যুবক নিজেকে তার স্বামী পরিচয় দেন। তবে আগে থেকে আলাপ না থাকায় ওই নারী তাকে চেনেন না বলে জানান। এরপর গার্মেন্টস ভিসায় বিদেশ যাচ্ছেন বলে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাদের বলেন ওই নারী। তাতে কর্ণপাত না করে ওই নারীকেও দেহব্যবসায়ী বানিয়ে মানব পাচার আইনে মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ওই মামলায় ভুক্তভোগী নারী জেলও খাটেন, যা মানব পাচার আইনের দুর্বলতা বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মো. শাহিন আলমের সঙ্গে হোয়াটঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। তবে প্রশ্ন শুনেই তিনি অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ফোন কেটে দেন। এরপর ফোন দিলেও তিনি আর ফোন ধরেননি। তবে এর কিছুক্ষণ পরই তার হয়ে একাধিক ব্যক্তি ফোন নিয়ে বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ না করার জন্য তদবির করেন। শাহিন আলমের ছেলে লিমনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এতবড় প্রতারণা একা কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। এখানে সরকারি কর্মকর্তা, রিক্রুটিং এজেন্সি, বিএমইটি, পাসপোর্টসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত। এই চক্রে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়াও যেসব নারী না বুঝে বিদেশে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাষ্ট্রকে।’