মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের গোলাম সারোয়ার ওরফে পাখি মৃধার বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে ৫ বছর বয়স কমিয়ে আপন ভাইয়ের সঙ্গে জমিজমা, সম্পত্তি-সংক্রান্ত মামলায় সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, গোলাম সারোয়ার ওরফে পাখি মৃধার জন্মতারিখ ১০ মার্চ ১৯৬২ (এনআইডি নং: ৯৫৬০৮৪৫০২৭) এবং তার ইমিডিয়েট বড় ভাই লালা মিয়া মৃধার জন্মতারিখ ১৩ অক্টোবর ১৯৬০। এখন গোলাম সারোয়ার পাখি মৃধা এনআইডিতে পাঁচ বছর বয়স কমিয়ে মামলায় জেতার পাঁয়তারা করছেন—এই অভিনব অপচেষ্টার ইতিহাস নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে।
সরেজমিনে তদন্তে জানা গেছে, পাখি মৃধা তার এনআইডিতে বয়স পরিবর্তনের জন্য মোহাম্মদপুর উপজেলা নির্বাচন অফিসে একাধিকবার যোগাযোগ করেন এবং বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই অনৈতিক কাজে তাকে সহায়তা করছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ (এনআইডি)-এর এক কর্মকর্তার আপন ভাই, যিনি সরাসরি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এই অনৈতিক তদবির ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন স্তরে মারাত্মক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, পাখি মৃধা তার মৃত বড় ভাই ফুল মিয়া মৃধার স্ত্রী ও সন্তানদের জমি আত্মসাতের জন্য দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকৌশল ও হয়রানিমূলক মামলা করেছেন। বসতভিটার দুই শতক জমি জোরপূর্বক দখল করে সেখানে গাছগাছালি লাগিয়ে খাচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের পূর্বে রোপণ করা ১৫/২০টি আমড়া গাছ তিনি রাতের অন্ধকারে কেটে ফেলে নিজে জায়গা দখল করেন এবং বর্তমানে সেখানে গাছ লাগিয়ে ফলভোগ করছেন।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে তৎকালীন ফুল মিয়া মৃধা স্থানীয় থানায় জিডি করেন এবং তদন্তে পাখি মৃধা দোষী সাব্যস্ত হন। তদন্তকারী কর্মকর্তা মোঃ লিয়াকত শরীফ (বিপি নং-৮৮০৮১৫০৮৯২) জানান, গোলাম সারোয়ার একজন জবরদখলকারী ব্যক্তি। তিনি বলেন, যতদূর শুনেছি তিনি আবার এনআইডি কার্ডে বয়স বাড়িয়ে ভুয়া মামলা করে নিজের পক্ষে অবস্থান তৈরির অপচেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে তার মেজ ভাই লালা মিয়া মৃধা বলেন, “(গোলাম সারোয়ার) একজন জবরদখলকারী। আমি যেখানে বসবাস করছি, সেই বসতভিটা আমাদের তিন ভাইয়ের ছিল। আমার ছোট ভাই আমাকে বসতবাড়ির এই সম্পত্তির তার অংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমার পাশের জমিতে পাকাবাড়ি করে বসবাস শুরু করে, পুকুর কাটে, গাছগাছালি লাগায়, কিন্তু আজও এই বসতবাড়ির জমি লিখে দেয়নি। এমনকি মাঠের জমিও অন্যের কাছে বিক্রি করে আমার মাধ্যমে সাব-রেজিস্ট্রি করিয়ে টাকা নিজে নিয়ে নিয়েছে। সত্যি কথা বলতে, বাড়ির জমিতে আমার বড় ভাইয়েরও হক ছিল, কিন্তু সে (পাখি) আমাকে লোভ দেখিয়ে সব করিয়ে এখন কিছুই দিচ্ছে না। আমি এখন মৃত্যুশয্যায়। আমার কিছু হলে তার (পাখির) দায়, কারণ সে আমাদের সর্বশান্ত করেছে। আপনাদের মাধ্যমে এর বিচার চাই।”
তিনি আরও বলেন, “এই বাড়ির জমি কমপক্ষে ২০ বার আমিন/মোহরী এনে মেপে ভাগাভাগি করা হয়েছে। কিন্তু ছোট ভাই গোলাম সারোয়ার ওরফে পাখি মৃধা কোনো কিছুই মানে না। এই জন্য আমি বৃদ্ধ বয়সে মানসিক দুশ্চিন্তায় আছি। আমি মারা গেলে আমার সন্তানরাও এই জমিজমা ফিরে পাবে না। আপনারা এর সঠিক বিচার করুন।”
ভুক্তভোগী পরিবার ইতোমধ্যে ঢাকা নির্বাচন কমিশনের মহাপরিচালক বরাবর গোলাম সারোয়ারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, এই বয়স জালিয়াতি শুধু একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে প্রতারণা নয়, বরং এটি পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি চরম অবমাননা ও এনআইডি অনুবিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে- যা রোধ করা এখন জরুরি।
মোহাম্মদপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, “অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা তদন্ত শেষে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। কোনো অনিয়ম করব না। তদন্তে গোলাম সারোয়ার পাখি মৃধার বিপক্ষে রিপোর্ট এসেছে। এরপরও যদি তার পক্ষ থেকে আবার অনিয়মের প্রস্তাব আসে, প্রয়োজনে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পাখি মৃধার মৃত ভাইয়ের স্বজনরা বলেন, “আমরা পরিবার নিয়ে নিরীহভাবে বসবাস করছি। পাখি মৃধা আমাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ/মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করেছেন। এখন তিনি এনআইডিতে বয়স বাড়িয়ে আমাদের বসতভিটা ও চাষি জমির মালিকানা দাবি করার ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অন্যায়।”
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পাখি মৃধা দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকৌশল ও প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, জালিয়াতি, মিথ্যা মামলা ও হুমকির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তারা বলেন, “জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথিতে ৫ বছরের বয়স পরিবর্তনের অপচেষ্টা শুধু প্রতারণা নয়, এটি আইনের অপব্যবহার ও সমাজে অনৈতিকতার জঘন্য দৃষ্টান্ত।” সচেতন মহল এবং এলাকাবাসী অবিলম্বে পাখি মৃধার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন, যাতে এই ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড দমন করে গ্রাম্য এলাকায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
উল্লেখ্য: প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও গোলাম সারোয়ার ওরফে পাখি মৃধার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।