অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এক আবেগঘন বার্তায় তিনি লিখেছেন—“শুভ জন্মদিন স্যার। আপনার মতো দূরদর্শী নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার জীবনের একটি অসাধারণ সম্মান।” শনিবার (২৮ জুন) দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরে নিজের ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি দীর্ঘ পোস্টে তিনি এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, এই লেখাটি তিনি রচনা করেছিলেন ২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি, এক গভীর হতাশার মুহূর্তে—যখন দেশ সদ্য একটি বিতর্কিত নির্বাচনের গ্লানি পার করেছে। তিনি লেখেন— “অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাধারণত আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারে আগ্রহী নন। তবু আপনি চাইলে তার সঙ্গে দেখা করা যায়, এবং তিনি আপনাকে পৃথিবীর বিভিন্ন জটিল বিষয়ের ওপর গভীর আলাপনায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানাবেন। তবে, তিনি রেকর্ডে কিছু বলতে চান না।
এ বছরের শুরুতেই একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মানবাধিকারকর্মী ও তার আইনজীবীদের মতে, এ রায় মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—তাকে ছোট করার, হেয় করার পরিকল্পনারই অংশ। ড. ইউনূস নিজে কখনো তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো নিয়ে মুখ খোলেন না। তিনি যেন গ্রিক স্টোয়িক দার্শনিকদের মতো, যিনি দুঃখ-কষ্টকে নীরবে ধারণ করেন, প্রতিক্রিয়াহীন থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। তার বিরুদ্ধে ১৭০টিরও বেশি মামলা রয়েছে—একটি দুর্নীতির মামলাও রয়েছে যার রায়ে তাকে দীর্ঘ সময় জেলে থাকতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা। আপাতত তিনি জামিনে মুক্ত, তবে এই অবস্থান কতদিন স্থায়ী থাকবে, সেটি অনিশ্চিত। অধ্যাপক ইউনূস নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের একজন প্রজ্ঞাবান, মনীষী নায়ক। তার জ্ঞানের ব্যাপ্তি কিংবদন্তির মতোই। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো—তিনি অর্থনীতি কিংবা ভূরাজনীতির মতো জটিল বিষয়েরও ব্যাখ্যা দিতে পারেন সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায়।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন দক্ষতা খুবই বিরল। আমি বহু উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছি, যারা অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডে পড়েছেন, কিন্তু বক্তৃতার গাঁথুনি, যুক্তির সারল্য ও বোধগম্যতায় তারা কেউই ড. ইউনূসের ধারে-কাছেও আসতে পারেন না। এ কারণেই ড. ইউনূসের প্রতিটি বক্তব্য থাকে পরিপক্ব, মার্জিত, চিন্তাশীল এবং হৃদয়স্পর্শী।” পোস্টে তিনি আরও লেখেন— “মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের ইউনূস সেন্টারে—যা শান্তিতে নোবেলজয়ী এই গুণীজনের অফিস—আজকাল যেন এক ধরনের স্থবিরতা ও নিরবতা বিরাজ করছে। ড. ইউনূস দেশে থাকলে এখানেই প্রতিদিন বিভিন্নজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খুব কম দেশীয় অতিথিই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা ভীত—ভবিষ্যৎ কী হবে, এই আশঙ্কায়। তবে ড. ইউনূস এসব নিয়ে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেন না। তিনি নিজের সন্নিহিত পরিবেশে শান্ত এবং স্থির।
ইউনূস সেন্টারের একটি সূত্র জানায়, সুইজারল্যান্ডে তার জন্য একটি অফিস ও জমি বরাদ্দ হয়েছে, যেখানে নতুন করে ইউনূস সেন্টার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রয়েছে। যদি তিনি সেখানে চলে যান, তাহলে তার আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত হতো, বিশেষ করে ‘সোশ্যাল বিজনেস’ ও ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সুবিধা হতো। কিন্তু তিনি দেশ ছাড়তে নারাজ। কারণ, বাংলাদেশই তার প্রিয় মাতৃভূমি—এখানেই তার শিকড়। তার প্রথম বিবাহ হয়েছিল একজন মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে, যা ভেঙে যায় মূলত এই কারণে যে, ড. ইউনূস বাংলাদেশেই থাকতে ও কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন দেশপ্রেমিক মানুষ খুব কমই দেখেছি। কিন্তু তিনি কখনো মুখে দেশপ্রেমের বুলি দেন না, বরং কাজের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করেন। ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি ৫০০ শয্যার সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার হাতে রয়েছে অর্থ, জমি সবই।
কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও অনুমোদনের নামে নানা জটিলতা তৈরি করে সে স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নকে বারবার আটকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তার প্রতিষ্ঠিত নার্সিং ইনস্টিটিউট দেশের সবচেয়ে দক্ষ নার্স তৈরি করে। তবু, সেই ইনস্টিটিউট সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয় অনুমতি এখনও তিনি পাননি। এসব নিয়েও তিনি কখনো মুখ খোলেন না। বরং পূর্বপুরুষদের মতো—যারা মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করতেন—তিনি কেবল একটি বিনীত, প্রশান্ত হাসি দিয়ে সবকিছু সামলে নেন।”