‘নতুন বন্দোবস্ত’—শব্দ দুটি শুনলেই মনে হয়, সমাজে এক নতুন সূচনার সম্ভাবনা এসেছে। যেন পুরনো পথ ভুলে এক নতুন গণতান্ত্রিক দিগন্তে যাত্রা শুরুর আহ্বান। কিন্তু বাস্তব চিত্রে আমরা এখনো অতীতের ছায়ায় বন্দী। গণঅভ্যুত্থান, পরিবর্তনের প্রত্যাশা, আন্দোলনের ঢেউ—সব মিলিয়ে দেশজুড়ে ছিল আশার আলো। অথচ আজো দেশের রাজনীতি রয়ে গেছে পুরনো কাঠামোর গণ্ডিতে, যেখানে নির্বাচন মানেই সংঘাত, আতঙ্ক, হুমকি আর প্রাণহানি।এই অচল সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। আর তার চমৎকার এক উদাহরণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের নির্বাচন পদ্ধতি। সদ্য শেষ হওয়া নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়ন পর্বে দেখা গেছে—কোনো বড় মিছিল, শোডাউন, বা বিশৃঙ্খলা নেই। নেই কাদা ছোড়াছুড়ি কিংবা প্রতিপক্ষকে দমন করার অপচেষ্টা। বরং, একজন তরুণ, অনেকটা অপরিচিত প্রার্থী জোহরান মামদানি নিজের যুক্তি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মপরিকল্পনা দিয়ে মন জয় করেছেন ভোটারদের। জনগণ তাকে বিশ্বাস করেছে, কারণ সে স্বচ্ছতা দেখিয়েছে, দায়িত্ববোধ দেখিয়েছে। আমেরিকায় নির্বাচনে প্রার্থীরা একে অপরের মুখোমুখি হন টেলিভিশনের বিতর্কে। সেখানে জনগণ সরাসরি দেখে—কে কেমনভাবে কথা বলেন, কী পরিকল্পনা দেন, কতটা আত্মবিশ্বাসী, কতটা যুক্তিবান। ভোটারদের সামনে খুলে দেওয়া হয় তথ্যের সব দরজা। তারা সিদ্ধান্ত নেন জ্ঞানের আলোকে, ভয়ের বশে নয়।
বাংলাদেশে আমরা তার ঠিক বিপরীত দৃশ্য দেখি। নির্বাচন মানে রাজপথে শোডাউন, পোস্টারে শহর ঢেকে যাওয়া, আতঙ্কের ছায়া, গুজব, প্রভাব বিস্তার, আর অবশেষে সহিংসতা। আমরা এখনো সেই পুরনো রাজনীতির কৌশলে আটকে আছি, যেখানে স্লোগানের চিৎকারে ডুবে যায় নীতির কথা। তবে সময় এসেছে ভাবনার দিগন্ত বদলানোর। আমাদের দরকার একটি রাজনৈতিক সংস্কার, যেখানে যুক্তিই হবে মূল শক্তি। যেমন, ধরুন কেউ যদি মেয়র প্রার্থী হতে চান, যেমন ইশরাক হোসেন, তবে তার উচিত হবে দলীয় মনোনয়ন পেতে দলের অভ্যন্তরে বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। সেখানে দলেরই আরও পাঁচজন প্রার্থী থাকুক। সবাই মিলে টেলিভিশনের স্টুডিওতে মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিক। তারা জনগণকে বোঝাক, কে এই শহরের জন্য কী পরিকল্পনা করেছে। কে শুধু আশ্বাস দিচ্ছে আর কে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা পেশ করছে। এই প্রক্রিয়াই হবে আমাদের 'নতুন বন্দোবস্ত'। যেখানে প্রার্থী হবেন জনগণের সামনে দায়বদ্ধ। যেখানে নেতা হওয়ার মানে হবে বিশ্বাস অর্জনের লড়াই, পেশি নয়, ভিশনের প্রতিযোগিতা। নিউইয়র্ক শহরে নির্বাচন হয়ে যায় নীরবে। রাস্তায় নেই ব্যানার, নেই পোস্টার, নেই শোডাউন। বরং মানুষের ব্যস্ততা নিজের কাজে, আর নির্বাচনের দিন ভোট দিয়ে এসে আবার কাজে ফেরে তারা। কেউ কারো পেছনে ছুটে বেড়ায় না, কেউ ভোট চুরি করে না, কেউ প্রতিপক্ষকে হুমকি দেয় না।
বাংলাদেশ কি এমন একটি নির্বাচন চিত্র কল্পনা করতে পারে না? যেখানে ভোট হবে উৎসব, উৎসাহের, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় ভরা। যেখানে নেতা নয়, নেতৃত্ব মূল্যায়িত হবে। এই পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝবেন—নেতৃত্ব মানে আর কেবল জনপ্রিয়তা নয়, বরং সক্ষমতা, সততা আর ভিশন। তখনই সম্ভব হবে টেলিভিশন স্টুডিওকে নির্বাচনী মঞ্চ বানিয়ে, প্রার্থীদের যুক্তির লড়াইয়ে নামিয়ে, জনগণের সামনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা। আমরা চাই, বাংলাদেশে রাজনীতির নতুন যাত্রা হোক সত্যিকারের নতুন বন্দোবস্ত দিয়ে। যেখানে যুক্তি হবে অস্ত্র, তথ্য হবে হাতিয়ার, আর বিবেক হবে ব্যালটের শক্তি। যেখানে টেলিভিশনের পর্দায় প্রার্থীরা মুখোমুখি হবেন, সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করবে, আর নেতারা জবাব দেবেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একজন যোগ্য নেতা উঠে আসবেন, যিনি আর কেবল দলের নয়, হবেন পুরো জনগণের প্রতিনিধি। আমরা চাই, এই সংস্কার বাস্তব হোক। যেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভোট মানে বুঝে দায়িত্ব, আর নির্বাচন মানে বুঝে উৎসব। জোর-জবরদস্তি, শোডাউন, সহিংসতা নয়—নতুন রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত হোক যুক্তির আলোয় আলোকিত। তখনই বাংলাদেশে গণতন্ত্র হবে পরিণত, পরিপূর্ণ।