“মা, তোমাকে ভালোবাসি”- মৃত্যুর আগে পর্বতারোহী জুলিয়ানার হৃদয়ছোঁয়া বার্তা। অদম্য সাহস আর স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ব্রাজিলের তরুণী জুলিয়ানা মেরিনস। প্রকৃতিকে জয় করার নেশায় তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার এক আগ্নেয়গিরিতে শেষ হয়ে গেল তার সব পথচলা। মৃত্যুর আগে তিনি মাকে পাঠিয়েছিলেন একটি আবেগময় বার্তা- “মা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।” সেই বার্তাই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল, আর তার মর্মান্তিক পরিণতি কাঁদাচ্ছে লাখো হৃদয়কে। জুলিয়ানা ছিলেন একজন পর্বতারোহী এবং পেশাদার পোল ড্যান্সার। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন এশিয়া ভ্রমণে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি তার দেশ ব্রাজিল থেকে যাত্রা শুরু করেন, গন্তব্য ছিলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। প্রতিটি জায়গায় তিনি নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছিলেন, পাহাড়-পর্বত জয় করছিলেন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে খুঁজে নিচ্ছিলেন। ২১ জুন, ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি মাউন্ট রিনজানিতে হাইকিং করার সময় ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটে। হঠাৎ পা পিছলে তিনি প্রায় ৪৯০ ফুট গভীর গিরিখাতে পড়ে যান। দুর্ঘটনার পর তিনি চার দিন ধরে জীবিত অবস্থায় সেখানে আটকে ছিলেন, কিন্তু ঘন কুয়াশা ও প্রতিকূল আবহাওয়া উদ্ধারকর্মীদের তার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। অবশেষে, মৃত্যু হয় এই নির্ভীক তরুণীর।
মাকে পাঠানো শেষ বার্তা। ভ্রমণের শুরুর দিকেই, ফিলিপাইন থেকে যাত্রা শুরু করার সময়, জুলিয়ানা তার মাকে একটি মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন- “মা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।” এই সংক্ষিপ্ত বাক্যে ফুটে উঠেছিল অসীম আবেগ। বার্তার বাকিতে তিনি আরও লিখেছিলেন, “বিদায়ের মুহূর্তে আমার মন ভেঙে গিয়েছিল। আমি কেবল এই ভেবেই ব্যথিত ছিলাম যে, তোমাকে, বাবাকে বা আমার বোনকে যেন কোনোভাবে হতাশ না করি।” জুলিয়ানা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি ভয় পান না। কারণ তিনি বড় হয়েছেন এমন একজন নারীর কাছে, যিনি ছিলেন তার আদর্শ। তিনি লিখেছিলেন- “আমি এমন একজন নারীর কাছে বড় হয়েছি, যিনি যেকোনো সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন, যিনি নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কোনো ভয় পান না। আমিও সেই পথেই হাঁটছি। আমার নিজের স্বপ্ন আছে। আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি। আর তোমাদের যত্ন, ভালোবাসা এবং সমর্থন আমাকে সাহসী করে তুলেছে।”
এই বার্তাগুলো আজ তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে - একজন সাহসী, সংবেদনশীল, স্বপ্নবান তরুণীর আত্মকথন। মৃত্যুর লড়াই ও উদ্ধার প্রচেষ্টা। দুর্ঘটনার দিন, ভোর ৬:৩০ মিনিটে তিনি নিচে পড়ে যান। ড্রোন ফুটেজে তার চিৎকার শোনা যায়, বোঝা যায় তিনি তখনো জীবিত ছিলেন এবং সাহায্য চাইছিলেন। কিন্তু আগ্নেয়গিরির উপরের কুয়াশা, ভারী বাতাস এবং দুর্গম পথ উদ্ধারকারীদের কার্যত অচল করে দেয়। কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি যেখানটায় পড়েছিলেন সেটি ছিল কাদায় ঢাকা, এবং ওই জায়গায় গিয়ে দড়ির সাহায্যে তাকে টেনে তোলা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। দীর্ঘ চার দিনের চেষ্টার পর, প্রতিকূলতা জয় করে উদ্ধারকারীরা তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। একটি অপ্রতিরোধ্য প্রেরণা, জুলিয়ানা ছিলেন শুধু একজন অভিযাত্রী নন, বরং ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নারী- যিনি সীমাবদ্ধতাকে কখনো বাধা মনে করেননি। তিনি তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দেখিয়েছেন কীভাবে সাহস, ভালোবাসা আর আত্মবিশ্বাস একজন মানুষকে আলোকিত করতে পারে।তার মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের জন্য এক কঠিন স্মারক- স্মারক এই যে, প্রিয়জনকে ভালোবাসা জানাতে কখনো দেরি করা উচিত নয়। জুলিয়ানার শেষ বার্তা ছিল তার মাকে, এবং সেই বার্তা আজ হাজারো হৃদয়ে বেদনার প্রতিধ্বনি হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে।
বিপজ্জনক পর্যটন গন্তব্য ও সতর্কতা, ইন্দোনেশিয়ার লম্বক দ্বীপে অবস্থিত মাউন্ট রিনজানি প্রায় ১২,০০০ ফুট উচ্চতার এক আগ্নেয়গিরি। এটি জনপ্রিয় ট্রেকিং গন্তব্য হলেও, সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মাত্র গত মাসেই এক মালয়েশীয় পর্যটকও একইভাবে প্রাণ হারান। শেষ কথাঃ ভালোবাসার চিরন্তন বার্তা, জুলিয়ানা মেরিনস আর নেই। কিন্তু তার লেখা সেই সহজ, সরল, অথচ গভীর এক কথার বার্তা- “মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি”- রয়ে গেল চিরন্তন হয়ে। এটি শুধুই একটি কণ্ঠ নয়, এটি এক অনুভব, এক শিক্ষা- যে ভালোবাসা কখনো মুছে যায় না, হারায় না, শুধু থেকে যায় প্রিয়জনের হৃদয়ে।