সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে আশুরার ঘটনাবলি অত্যন্ত তাৎপর্যময়। পৃথিবীর শুরু থেকেই এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তবে কারবালার প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এই দিনটিকে আরও বেদনাবিধুর ও স্মরণীয় করে তুলেছে। ইসলামের ইতিহাসে এ ঘটনা এক মর্মান্তিক ও কালো অধ্যায়, যা আজও মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর বেদনা সৃষ্টি করে। ঘটনার সূত্রপাত হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মৃত্যুর পর, যখন তার ছেলে ইয়াজিদ অন্যায়ভাবে খিলাফতের ক্ষমতা দখল করে। ইয়াজিদ ছিল মদ্যপ, নিষ্ঠুর এবং চরিত্রহীন। তার কারণে অধিকাংশ মুসলমান তাকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি। এর বিপরীতে মদিনা ও কুফার জনগণ ইমাম হোসাইন (রা.)-কে তাদের নেতা হিসেবে দেখতে চায়। কুফাবাসী তাকে পত্র লিখে সুন্নাহ পুনর্জীবিত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানায়।
সেই সময় ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা-মদিনায় অবস্থান করছিলেন। অনেকেই তাকে কুফা যেতে নিষেধ করেছিলেন, কারণ তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে বিপদের সময় কুফাবাসী তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য তিনি তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠান। সেখানে পৌঁছে ১৮ হাজার মানুষ ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পক্ষে বাইয়াত করে। এতে আশ্বস্ত হয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার ও অনুচরসহ কুফার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ইয়াজিদ এ খবর পেয়ে কুফার গভর্নর বদল করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে দায়িত্ব দেয় এবং নির্দেশ দেয়—ইমাম হোসাইন যেন কুফায় প্রবেশ করতে না পারেন। ইবনে জিয়াদ কুফায় পৌঁছে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করে এবং হোসাইন (রা.)-এর বিরুদ্ধে বাহিনী প্রেরণ করে। কারবালার ময়দানে পৌঁছার পর হোসাইন (রা.)-এর কাফেলাকে ঘিরে ফেলা হয় এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়। পানির জন্য হাহাকার শুরু হলে তিনি কুফাবাসীদের বলেন, "আমি যুদ্ধ করতে আসিনি, তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি। এখন যদি তোমরা মত পরিবর্তন করো, আমাকে যেতে দাও। আমি মদিনায় ফিরে যাব বা সীমান্তে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, কিংবা ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনায় বসব।" কিন্তু তাকে বলা হয়, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে। হোসাইন (রা.) এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।
১০ মহররম, আশুরার সকালে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায়। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পরিবারের সবাই একে একে শহীদ হন। তিনি একাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেন। এক পর্যায়ে সীমার নামের এক পাপিষ্ঠ তাঁর পবিত্র মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। তার দেহে ৩৩টি বর্শার ঘা, ৩৪টি তরবারির আঘাত ও অসংখ্য তীরের ক্ষত ছিল। ওই যুদ্ধে তাঁর একমাত্র পুত্র হজরত জয়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া বাকিরা সবাই শহীদ হন। হোসাইন (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর মস্তক বর্শার ফলায় বিদ্ধ করে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াজিদও তার নিষ্ঠুর কর্মফল থেকে রক্ষা পায়নি। মাত্র চার বছরের মধ্যে তার মৃত্যু হয় এবং তার বংশ আর কখনো শাসনে ফিরে আসেনি। এ হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল, তারা সবাই পরবর্তীতে নির্মম পরিণতি ভোগ করে। ইমাম হোসাইন (রা.) আজও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে মুসলিম সমাজে অমর। তাঁর আত্মত্যাগ যত দিন ইসলাম থাকবে, তত দিন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।