রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে ন্যাটোর অস্ত্রভাণ্ডারে আরও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে, কারণ ধারণা করা হচ্ছে মস্কো খুব শিগগিরই এ ধরনের অস্ত্রের উৎপাদন বাড়াবে। এক মার্কিন জেনারেল রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে যেভাবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সফলতা পেয়েছে, তাতে পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—শত্রুপক্ষের গভীরে থাকা কমান্ড সেন্টার, রসদ সরবরাহ কেন্দ্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ স্থান গুঁড়িয়ে দিতে এ ধরনের অস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানির উইসবাডেনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল জন র্যাফার্টি বলেন, “ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ের তুলনায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী এখন অনেক বড় হয়েছে। তারা এখনো দূরপাল্লার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র এবং উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ন্যাটোর সক্ষমতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।” ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ ইউরোপকে আরও বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে, এবং কিয়েভ এখন তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে চায়।
সম্প্রতি র্যাফার্টি মার্কিন সেনাবাহিনীর ৫৬তম আর্টিলারি কমান্ডের দায়িত্ব শেষ করেছেন। এই কমান্ডটি ২০২৬ সাল থেকে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সাময়িকভাবে মোতায়েনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সোমবার জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের সঙ্গে এক বৈঠকে নিশ্চিত করতে চান, জো বাইডেন প্রশাসনের আমলে হওয়া ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন সংক্রান্ত চুক্তিগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় এলেও বহাল থাকবে কি না। উল্লেখযোগ্য চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে ১,৮০০ কিলোমিটার পাল্লার টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ও ৩,০০০ কিলোমিটার পাল্লার উন্নয়নাধীন হাইপারসনিক অস্ত্র ‘ডার্ক ঈগল’ মোতায়েনের পরিকল্পনা। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন পরিকল্পনাকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। যদিও তারা দাবি করছে, ন্যাটোর সম্প্রসারণই ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলার অন্যতম কারণ, ন্যাটো সদস্যদের ওপর তাদের আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা নেই।
ইউরোপীয় প্রস্তুতি
অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও পিএইচডি গবেষক ফাবিয়ান হফম্যান জানান, বর্তমানে ন্যাটোর দূরপাল্লার হামলার সক্ষমতার প্রায় ৯০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করে। তিনি বলেন, “আধুনিক যুদ্ধে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যদি আপনার কাছে এসব অস্ত্র না থাকে, তাহলে আপনি বড় ঝুঁকিতে থাকবেন।” এই হুমকি অনুধাবন করেই ইউরোপের ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে শুরু করেছে, যার গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপের কারণে। ইউরোপের কিছু দেশের নিজস্ব দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র থাকলেও সেগুলোর সংখ্যা ও ক্ষমতা সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম। ব্রিটিশ স্টর্ম শ্যাডো, ফরাসি স্ক্যাল্প এবং জার্মান টরাসের মতো ইউরোপের আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত। ফ্রান্সের সমুদ্র থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য এমডিসিএন ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে আঘাত হানতে পারে।
এসব ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে ইউরোপের অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এমবিডিএ, যার কার্যালয় রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালিতে। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও সুইডেন মিলে এখন "ইউরোপীয় লং-রেঞ্জ স্ট্রাইক অ্যাপ্রোচ (ইএলএসএ)" নামে একটি কর্মসূচির আওতায় ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহে একসঙ্গে কাজ করছে। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে ব্রিটেন ও জার্মানি যৌথভাবে ২,০০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের ঘোষণা দেয়।