২০২৪ সালের ১৭ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে গায়েবানা জানাজা সম্পন্ন করেন আন্দোলনকারীরা। সকালেই আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করে ক্যাম্পাসকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। একইসঙ্গে সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। পবিত্র আশুরার সরকারি ছুটির দিনে সারা দেশে বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মতো নানা ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এদিন আন্দোলনকারীরা মেয়র হানিফ উড়াল সড়কের কাজলা অংশে আগুন ধরিয়ে দেন এবং অন্তত ২০টি স্থানে আগুন জ্বালানো হয়।
এর আগের দিন, ১৬ জুলাই ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ সারাদেশে ছয়জন নিহত হন। ঢাকা, রংপুর ও চট্টগ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহতদের স্মরণে ১৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা আয়োজন করে, কিন্তু পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে বিকেলে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে আন্দোলনকারীরা কফিন ধরে শপথ করেন এবং স্লোগানে জানান, তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এরপর পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তারা টিএসসি অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পুলিশ বাধা দিয়ে আবারও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। শিক্ষার্থীরা সেখানেই অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম অভিযোগ করেন, পুলিশ ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশ পথে শিক্ষার্থীদের আটকায় এবং টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গায়েবানা জানাজায়ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাধা দেন ও কোথাও কোথাও হামলাও চালান। ইউজিসি সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, পুলিশ হল খালি করার অনুমতি পেয়েছে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হল না ছাড়লে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ১৬ জুলাই রাতে আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হন, কক্ষ ভাঙচুর করেন এবং হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার অঙ্গীকারনামায় প্রাধ্যক্ষদের স্বাক্ষর আদায় করেন। আন্দোলনে পুলিশের বর্বর হামলা, হতাহতের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার ও কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ১৮ জুলাই দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়। ফেসবুকে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে আন্দোলনকারীদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী কোটা আন্দোলনকে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে চলে যাওয়ার অভিযোগ করেন এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। ১৭ জুলাই শহীদ আবু সাঈদকে রংপুরের পীরগঞ্জে দাফন করা হয়। জাফরপাড়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে সকাল সোয়া ৯টায় জানাজা ও পরে দাফন সম্পন্ন হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর আয়োজিত গায়েবানা জানাজায়ও পুলিশ বাধা দেয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, সরকার আলোচনার মাধ্যমে কোটা সমস্যার সমাধান না করে বর্বরভাবে মানুষ হত্যা করেছে। চট্টগ্রামেও বিকেলে লালদীঘি ময়দানে হাজারো ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সারা দেশে কমপক্ষে ১০টি স্থানে সড়ক-মহাসড়ক ও দুটি স্থানে রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করেন।