গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শান্তিপূর্ণ লংমার্চে যে নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে, তা নিছক একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাধা দেওয়ার ঘটনা নয়-এটি ছিল গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার ও দেশের সংবিধানসম্মত শাসনব্যবস্থার ওপর এক সরাসরি আঘাত। এ হামলা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে-ক্ষমতা হারালেও আওয়ামী লীগ এবং তাদের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠনগুলো এখনো সন্ত্রাস ও সহিংসতার পথেই রয়ে গেছে। হামলার ফলে কমপক্ষে চারজন নিহত হয়েছেন এবং অসংখ্য মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। সমাবেশের জন্য নির্মিত মঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়েছে, সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে। এমনকি ঢাকায় ফেরার পথে নিরস্ত্র এনসিপি নেতাকর্মীদের গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে তাদের যাত্রাপথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এই বর্বর কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে আওয়ামী লীগের সহিংস অনুসারীদের হাতে-যাদের কার্যক্রম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। প্রশাসন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে, নাকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব নেবে-এই মুহূর্তে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, হামলার কেন্দ্রস্থল গোপালগঞ্জ। বারবার প্রশ্ন উঠছে-গোপালগঞ্জ কি দেশের সংবিধানের বাইরে কোনো স্বশাসিত এলাকা? বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা গেলেও, গোপালগঞ্জে গেলেই কেন তা ‘উসকানি’ বলে আখ্যায়িত হয়? সেখানে কি আর সংবিধানসম্মত সভা-সমাবেশের অধিকার প্রযোজ্য নয়? আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে গোপালগঞ্জকে তাদের ব্যক্তিগত জমিদারি কিংবা পারিবারিক দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সম্প্রতি দেশের জনগণ ‘জুলাই বিপ্লব’-এর মাধ্যমে সেই কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। আজ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেও, গোপালগঞ্জে তাদের সন্ত্রাসী দাপট কেন এখনো অব্যাহত? অনেকেই মনে করছেন, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কিছু নেপথ্য উসকানি এসেছে বলেই এই সহিংসতা ঘটেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে-এটি কি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন হামলা, নাকি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে চলমান একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? এমন একসময় আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই-বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী গোপালগঞ্জ কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা বিচ্ছিন্ন রাজ্য নয়। এটি বাংলাদেশেরই একটি জেলা, যেখানে সংবিধান, আইন ও নাগরিক অধিকার সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। যারা গোপালগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন শক্তির দুর্গে পরিণত করতে চায়, তাদের প্রতিহত করাই এখন সময়ের দাবি।
সরকারকে অবিলম্বে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। যারা এই জঘন্য হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্ট নির্দেশ দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা না দিতে পারে। অন্যথায়, জনগণের মাঝে বিশ্বাস জন্মাবে যে-গোপালগঞ্জ একটি ‘নিষিদ্ধ সংগঠনের দখলে থাকা’ এলাকা, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠবে।আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থানেও অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। তারা এখনো সেই পুরোনো সন্ত্রাসবাদী মানসিকতা নিয়ে গোপালগঞ্জকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। গোপালগঞ্জ বাংলাদেশেরই অংশ-এই সত্য তারা ভুলে যেতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র যেন তা ভুলে না যায়।সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগ আজ আর একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল নয়। তারা এক আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, যারা গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক সহিংসতা চালিয়ে দেশের স্থিতি ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শৈথিল্য বা দেরি আর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।