পথচারীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের পর চাপাতি হাতে নির্বিঘ্নে পুলিশের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ছিনতাইকারী। অথচ রাস্তায় দায়িত্বে থাকা দুই ট্রাফিক পুলিশ সদস্য এই দৃশ্য দেখেও নিষ্ক্রিয়। এই ভয়াবহ ঘটনাটির একটি ভিডিও গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘটনাটি ঘটেছে ১৭ জুলাই, বৃহস্পতিবার রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রাসেল স্কয়ার এলাকায়। রাজধানীর রাস্তায় ছিনতাইকারীদের হাতে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র থাকার চিত্র এখন প্রায় নৈমিত্তিক। ঢাকার বাইরেও চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি ও চুরির মতো অপরাধ বেড়েই চলেছে। অভিযানের পরও অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না, বরং সারাদেশে অপরাধের হার বেড়েই চলেছে। প্রেস উইংয়ের সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ছয় মাসে খুনের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। জানুয়ারিতে খুনের মামলা ছিল ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০টি, মার্চে ৩১৬টি, এপ্রিলে ৩৩৮টি, মে মাসে ৩৪১টি এবং জুনে এ সংখ্যা পৌঁছায় ৩৪৪-এ। সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে ঢাকা মহানগর, ঢাকা রেঞ্জ এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জে। এসব ঘটনার পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের বিষয়ও জড়িত।
খুন ছাড়াও সারাদেশে ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। রাজধানীর মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলমান, আবার নতুন করে ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু হয়েছে। তবু গত ছয় মাসের পরিসংখ্যানে আশাব্যঞ্জক কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু মামলা-সংখ্যা প্রকাশ করে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। অভিযান চলছে, অপরাধী তবু ধরাছোঁয়ার বাইরে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য দিয়ে বলছেন, দেশে কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু গোপালগঞ্জে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনায় তিনি স্বীকার করেছেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য ছিল, কিন্তু এমন বড় কিছু হবে তা অনুমান করতে পারিনি।’ তিনি কখনো 'ডেভিল হান্ট', কখনো 'চিরুনি অভিযানের' ঘোষণা দিলেও বাস্তবে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাটছে না। এমনকি দিনের আলোতেও রাজধানীতে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছে মানুষ। প্রশ্ন উঠছে-এই অপরাধীদের লাগাম কে টানবে? রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বিশেষ বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দাবি করেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। পুলিশের আস্থা ও মনোবলের সংকট, সংশ্লিষ্টদের মতে, পুলিশ সদস্যরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৩২৯টি মামলা হয়েছে, যা আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি। এ সময় থানায় শুধুমাত্র দৃশ্যমান খুনের ঘটনায় মামলা হয়, অজ্ঞাত বা রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণত অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। তারপরও খুনের ঘটনা বেড়েছে। অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না। যারা থানায় যান, তাদের অনেককেই জিডি করতে বলা হয়। চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনায় অনেকে অতিরিক্ত ঝামেলা এড়াতে পুলিশের দ্বারস্থ হন না। ছয় মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ এবং পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় মামলা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে।
সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে। সুযোগসন্ধানীরা সেই সুযোগে নানা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। পুলিশের ভূমিকা আরও কঠোর না হলে পরিস্থিতি বদলাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায় নিতে হবে। গোপালগঞ্জের ঘটনার মতো ব্যর্থতা স্বীকার না করে চলবে না। যারা এসব ব্যর্থতার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ তাঁর মতে, ‘বর্তমানে অনেক অপরাধের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধনও আছে। কিছু সুযোগসন্ধানী পরিস্থিতি ঘোলাটে করে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করছে, যা কঠোরভাবে দমন করা জরুরি।’ সম্প্রতি পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এক ব্যবসায়ীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর গোপালগঞ্জমুখী একটি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চারজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ‘চিরুনি অভিযান’ ঘোষণার দুই দিনের মাথায় ধানমন্ডিতে প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরপেক্ষতা দরকার’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এজন্য নিরপেক্ষভাবে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার নিরব থেকেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এখন পুলিশের কার্যক্রম মন্থর হয়ে গেছে, যার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।’
পরিসংখ্যানের বাইরে লুকানো বাস্তবতা, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে খুনের ঘটনা বেড়েছে। ২০২০ সালে ৩৫৩৯টি, ২০২১ সালে ৩২১৪টি, ২০২২ সালে ৩১২৬টি, ২০২৩ সালে ৩০২৩টি এবং ২০২৪ সালে ৪১১৪টি খুনের মামলা হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণেই ২০২৪ সালের সংখ্যা বেড়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য।
২০২০–২০২৩ সালে চার বছরে গড়ে প্রতি মাসে ২৬৯টি খুনের মামলা হয়েছে। অথচ ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যেই ১৯৩৩টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে ডাকাতির ঘটনায় জানুয়ারিতে মামলা ছিল ৭১টি, যা জুনে কমে ৪৯টি হয়। কিন্তু ছয় মাসে মোট ৩৬৭টি মামলা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় বেশি। একইভাবে দস্যুতার মামলা হয়েছে ৯৭২টি। অপহরণের মামলা ৫১৭টি, যা আগের বছরের পূর্ণ সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ কেবল মামলার হিসাব ধরে অপরাধ পরিসংখ্যান তৈরি করে, যার কারণে এটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। অনেক অপরাধ ঘটনাই এসব পরিসংখ্যানে আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘ডেভিল হান্ট অপারেশনে ৫ হাজারের বেশি অপরাধী ধরা পড়ার পরও যেহেতু অপরাধ চলছে, তাহলে প্রশ্ন আসে-এই অপরাধীরা আগে কোথায় ছিল? সমন্বয়হীনভাবে অপরাধ দমনে অভিযান চালালে তাতে তেমন সুফল মিলবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের পরিসংখ্যান কেবল তাদের কাছে রিপোর্ট হওয়া ঘটনা নিয়ে তৈরি। এর বাইরেও অসংখ্য অপরাধ সংঘটিত হয়, যেগুলো এই তালিকায় আসে না।’