স্পেসএক্সের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) একটি সফটওয়্যারজনিত অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু ব্যবহারকারী কয়েক ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ হারিয়ে ফেলেন, যা স্টারলিংকের ইতিহাসে অন্যতম গুরুতর ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। এই তথ্য উঠে এসেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে। স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা (১৯০০ জিএমটি) থেকে ব্যবহারকারীরা একের পর এক সংযোগ হারানোর কথা জানাতে থাকেন। প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভ্রাট পর্যবেক্ষণকারী সাইট ডাউনডিটেক্টরের তথ্যমতে, এই সময় প্রায় ৬১ হাজার ব্যবহারকারী বিভ্রাটের রিপোর্ট জমা দেন। বর্তমানে স্টারলিংকের ছয় মিলিয়নের বেশি গ্রাহক রয়েছে বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ ও অঞ্চলে। এত বড় বিভ্রাটের পর স্টারলিংকের অফিসিয়াল এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে জানানো হয় যে, তারা সমস্যার সমাধানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
স্টারলিংকের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল নিকলস এক্সে জানান, এই বিভ্রাটের মূল কারণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যার সেবার ব্যর্থতা। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সমস্যার উৎস চিহ্নিত করে তা ভবিষ্যতে প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কও এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে এক্সে লেখেন, “এই বিভ্রাটের জন্য দুঃখিত। আমরা সমস্যার উৎস শনাক্ত করেছি এবং নিশ্চিত করব যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে।” স্টারলিংকের এই প্রযুক্তিগত সমস্যার প্রভাব পড়ে ইউক্রেনের সামরিক যোগাযোগেও। রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যাপকভাবে স্টারলিংক টার্মিনাল ব্যবহার করছে, বিশেষ করে ড্রোন পরিচালনা ও যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে। ইউক্রেনের ড্রোন ইউনিটের এক কমান্ডার রবার্ট ব্রোভদি টেলিগ্রামে লেখেন, “স্টারলিংক পুরো ফ্রন্টলাইনে বন্ধ ছিল।” তিনি জানান, বিভ্রাটটি রাত ১০:৪১ থেকে শুরু হয়ে রাত ১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
ব্রোভদি বলেন, “ভিডিও ফিড না থাকায় যুদ্ধ চলেছে, ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে। এটি থেকে প্রমাণ হয়, একমাত্র ইন্টারনেটনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থার উপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ। বিকল্প ব্যবস্থা থাকা জরুরি।” রয়টার্সকে দেওয়া এক মন্তব্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ড্রোন কমান্ডার জানান, এই বিভ্রাটের কারণে তাদের একাধিক অভিযান বাতিল করতে হয়েছে। ‘ওচি’ নামক ফ্রন্টলাইনে ব্যবহৃত একটি ভিডিও ফিড সিস্টেমের প্রতিষ্ঠাতা ওলেক্সান্ডার দিমিত্রিয়েভ বলেন, “যখন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, তখন কার্যকর সামরিক অভিযান পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।” তিনি স্থানীয়ভাবে নির্ভরযোগ্য বিকল্প ব্যবস্থা তৈরির পরামর্শ দেন। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, এই বিপর্যয়ের পেছনে সফটওয়্যার ত্রুটি, ব্যর্থ আপডেট অথবা সাইবার হামলার মতো কোনো কারণ থাকতে পারে। কর্নেল ইউনিভার্সিটির স্পেস ও সাইবার সিকিউরিটি ল্যাবের পরিচালক গ্রেগরি ফ্যালকো বলেন, “আমার ধারণা, এটি কোনো ব্যর্থ সফটওয়্যার আপডেটের ফল, যা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া ক্রাউডস্ট্রাইক বিভ্রাটের মতো।”
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালে একটি ত্রুটিপূর্ণ ক্রাউডস্ট্রাইক আপডেটের কারণে বিশ্বজুড়ে উইন্ডোজ কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলেন, বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছিল এবং লক্ষাধিক ডিভাইস ইন্টারনেট সংযোগ হারিয়েছিল। স্টারলিংকের সামরিক সেবা ও রাশিয়ার ব্যবহারের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। স্টারলিংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই বিভ্রাট স্টারশিল্ড নামে পরিচিত সামরিক সংযোগ কিংবা অন্যান্য উপগ্রহভিত্তিক সেবায় প্রভাব ফেলেছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। স্টারশিল্ড হচ্ছে স্পেসএক্সের একটি সামরিক প্রকল্প, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কোটি কোটি ডলারের চুক্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, যদিও স্টারলিংক রাশিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে চালু নেই, ইউক্রেনের অভিযোগ- রুশ বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে স্টারলিংক টার্মিনাল ব্যবহার করছে। ২০২২ সালে ইলন মাস্ক ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে স্টারলিংক সেবা সীমিত করার নির্দেশ দেন, এমন সময় যখন ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার দখল থেকে অঞ্চল পুনর্দখলের চেষ্টা করছিল। সরকারি তথ্যমতে, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ইউক্রেন ৫০ হাজারের বেশি স্টারলিংক টার্মিনাল পেয়েছে, যা দেশটির সামরিক ও জরুরি যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।