কুমিল্লা সরকারি কলেজের ছাত্র সৌরভ চক্রবর্তী। তার স্বপ্ন ছিল দেশের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা সম্পন্ন করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজের মতো জীবন গড়া। কিন্তু সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জুলাই মাসের অভ্যুত্থান। ছাত্রলীগের ছোড়া ককটেলের স্প্রিন্টারে আক্রান্ত হয়ে তার এক চোখের আলো নষ্ট হয়েছে। টানা সাত মাস দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, পাঠ্যবই থেকে অনেক দূরে। স্বল্প প্রস্তুতি এবং চোখের অপ্রকাশ্য আলোয় নিয়েই অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন সে।
সৌরভ চক্রবর্তী চিলোড়া গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উচ্চবংশীয় পরিবারের সন্তান। পিতা দিলীপ চক্রবর্তী পৈত্রিক পেশায় পুরহিত। দুই ছেলে, তন্ময় ও সৌরভকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। ছোট ছেলে সৌরভ কুমিল্লা সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্সে পড়াশোনা করছিল। ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট কুমিল্লা মহানগরীর পুলিশ লাইন এলাকায় ছাত্রদের আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের ছোড়া একের পর এক ককটেল স্প্রিন্টারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। এতে তার ডান চোখ, নাক এবং বুকে একাধিক আঘাত লাগে। সহপাঠিরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়।
সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “সেদিন আমরা খালি হাতে আন্দোলনে নামি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে আমাদের ঘিরে ফেললে প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে শুরু করি। তাতেও রক্ষা হয়নি, ছোড়া ককটেল স্প্রিন্টারে মারাত্মক আহত হই। প্রথম কয়েকদিন তেমন চিকিৎসাও পাইনি। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের সাহায্যে উন্নত চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে। তবুও চোখের সম্পূর্ণ আলো ফিরে পাইনি। এখনও আবছায়া অবস্থায় দিন পার করছি। গত মাসে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি, ডান চোখের অপ্রকাশ্য আলো নিয়ে পড়াশোনা করেছি। ৬–৭ মাস চিকিৎসার কারণে পরীক্ষা প্রস্তুতি যথাযথভাবে নিতে পারিনি। স্বপ্ন ছিল মাস্টার্স শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার, নিজস্বভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করার। মনে হয় সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।”
সৌরভের বাবা দিলীপ চক্রবর্তী বলেন, “ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিল। বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বিধিবাম, সেই ইচ্ছা আর পূরণ হবে না। চোখ ভাল না হলে সবকিছু শেষ। চিকিৎসায় অন্তত ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, সরকার থেকে ১ লাখ টাকা পেয়েছি, এখনও চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।”
এ ঘটনা শুধু এক দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের সমাজের সহিংস রাজনীতির দৃষ্টান্ত। যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কলম ধরার কথা, সেখানে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্যান্ডেজ, চোখ হারানোর আতঙ্ক।
প্রসঙ্গত, জুলাই অভ্যুত্থানে গেজেটভুক্ত তালিকায় চান্দিনা উপজেলার একজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছেন। ‘খ’ শ্রেণীতে তিনজন আহত, যার মধ্যে একজন সৌরভ। ‘গ’ শ্রেণীতে আরও সাতজন আহত। নিহত তালিকায় একজন ইমাম হাসান তায়িম ভূইয়া, যিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।