চব্বিশের জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়, যা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরও দুইজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল, রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জেরা সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর। বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলাটির পলাতক আসামি শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন চৌধুরী সাবেক আইজিপি মামুনকে জেরা করেন। এর আগে, গত ২ সেপ্টেম্বর মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি জানান, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাকে ফোন করে জানায় যে আন্দোলন দমনের জন্য সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তখন পুলিশ সদর দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন এবং তার সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। পরে এই নির্দেশনা ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পৌঁছে যায়। সেদিন থেকেই বিভিন্ন মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। জবানবন্দিতে মামুন উল্লেখ করেন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনাকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, যার মধ্যে ছিলেন ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমন করতে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে করা হয়েছিল, যার পরামর্শ দিয়েছিলেন র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ। আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোকে ব্লক করে, হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করে, সহ অগণিত ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করা হয়। এ সময় সরকারের পক্ষের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ী দলগুলিও এই প্রক্রিয়ায় উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন আরও জানান, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে ‘কোর কমিটি’-এর বৈঠক প্রতি রাতে ধানমন্ডির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হতো, যেখানে আন্দোলন দমন ও সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্তও সেই বৈঠক থেকে আসে। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়, যদিও তিনি প্রথমে বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তা কার্যকর করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, আন্দোলন দমনের সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করত এবং ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে রাতে সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে পরিকল্পনা নেওয়া হতো। তিনি বলেন, সেখানেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিজিএফআই ও এসবি প্রধান এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। মামুন জবানবন্দিতে জানান, ২৭ জুলাই আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি যান। সেই সময় ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে দেখা যায় ‘গুলি করা হলে একজন মারা যাবে, বাকিরা বাঁচবে’। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের মাধ্যমে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। সরকার সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে এবং যারা তা পালন করেন তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে তিনি জানান, ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের আটক, অপহরণ ও নির্যাতন একটি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছিল। নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসে এবং চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে বাস্তবায়ন করা হতো। জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি আরও বলেন, তিনি এই গণহত্যার ঘটনায় নিজেকে দায়ী মনে করেন, পুলিশের দায়িত্ব পালনকালে হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ট্রাইব্যুনালে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আমি ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার অপরাধবোধ রয়েছে এবং আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে বাকি জীবনে কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।” চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সাক্ষ্যকে ট্রাইব্যুনাল অপ্রতিরোধ্য ও অকাট্য হিসেবে বিবেচনা করবে। এটি শুধু জুলাই-আগস্টের ঘটনা নয়, বরং গত ১৫ বছরে দেশে যত গুম ও খুন হয়েছে তার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবেও কাজ করবে।
মামলার প্রসিকিউশন টিমে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন, আর সাবেক আইজিপি মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ।