গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা হারিয়ে দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আশ্রয় নেন ভারতে। সেখান থেকেই তিনি কড়া নিরাপত্তার মধ্যে থেকে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা টানা প্রায় ৪৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে তার এই যাত্রা শুরু। কিন্তু বর্তমানে এসে দলটি তীব্র নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে। কারণ, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের হাল ধরার মতো উপযুক্ত কোনো নেতা ভেতরে নেই। ফলে সংগঠনের ভেতরেও নেতৃত্বহীনতা স্পষ্ট। তবে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো প্রকাশ্যে বলেননি বা ইঙ্গিত দেননি, অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব কার হাতে যাবে কিংবা উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা কী। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মতো বিশাল একটি দলের সংগঠন ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল এই দুর্বলতা। পরে অন্তর্বর্তী সরকার দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করে দেয়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা ভারতের ‘অতিথি’ হয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন। তার চলাফেরা থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত—সবকিছুতেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই পরিস্থিতি ও চাপের মধ্যেই তাকে এখন উত্তরাধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তাছাড়া বয়সও একটি বিষয়-চলতি মাসে তিনি ৭৮ বছরে পা দিচ্ছেন।
এই অবস্থায় ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকেও রাখা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। এক্ষেত্রে ভারতের কংগ্রেস দলের মতোই আওয়ামী লীগের জন্য তিনি ছেলেমেয়েকে সামনে আনার পরিকল্পনা করছেন। কংগ্রেস যেমন রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সামনে রেখে দল পরিচালনা করছে, শেখ হাসিনাও তেমন ‘মডেল’ প্রয়োগ করতে চাইছেন। দুই মাস আগে পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ‘রিজিওনাল ডিরেক্টর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সায়মা ওয়াজেদ। কিন্তু অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানো হলে তিনি এখন সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে, সজীব ওয়াজেদ যদিও মার্কিন নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা, তবুও তিনিই দলের প্রধান মুখ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মিত দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।
কিন্তু মায়ের সঙ্গে একই শহর ও টাইম জোনে থাকার কারণে সায়মা ওয়াজেদ আরও সরাসরি তাকে সহযোগিতা করতে পারছেন। মায়ের ভাষণের খসড়া তৈরি থেকে কর্মসূচি নির্ধারণ-সবকিছুতেই তিনি ভূমিকা রাখছেন। এমনকি বাইরের দর্শনার্থীদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনার হয়ে দায়িত্ব নিচ্ছেন সায়মা। গত দু’মাসে তিনি একাধিক বৈঠক করেছেন। আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার এই ‘সাকসেসন প্ল্যান’ নিয়ে ভারতসহ দেশের বাইরে থাকা শীর্ষ নেতারা কথা বললেও প্রকাশ্যে কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, “আপনি যে উত্তরাধিকার পরিকল্পনার কথা বলছেন, সেটা এখন আমাদের অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য কেবল বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।”
এদিকে, হু থেকে ছুটিতে যাওয়ার পর গত মাসেই সায়মা ওয়াজেদ তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার রাজনৈতিক পোস্ট করা শুরু করেছেন। এর মধ্যে ছিল খালাতো বোন টিউলিপ সিদ্দিক ও বড় ভাই সজীব ওয়াজেদের কিছু পোস্ট শেয়ার। আগে রাজনৈতিক মন্তব্য থেকে দূরে থাকলেও এখন সক্রিয় হয়ে ওঠায় অনেকে মনে করছেন, তার হু-তে ফেরার সুযোগ আর নেই। ভারতের কংগ্রেসে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলটি দাঁড়িয়েছে এভাবে-সোনিয়া গান্ধী ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাচ্ছেন, আর সামনের সারিতে আসছেন তার ছেলে রাহুল গান্ধী। প্রিয়াঙ্কা ভাইকে সহযোগিতা করছেন কিন্তু তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন না। আওয়ামী লীগের জন্য শেখ হাসিনাও একই পথ অনুসরণ করতে চাইছেন বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নতুন এই কাঠামোয় কার্যত উপেক্ষিত। প্রায় দশ মাস ধরে ভারতে থাকা সত্ত্বেও তিনি এখনও দলের সভাপতির দেখা পাননি। বরং শেখ হাসিনা এখন বেশি ভরসা রাখছেন কলকাতায় অবস্থানরত তিনজন নেতার ওপর-সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাসিম এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। সূত্র বলছে, তারা সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং নিয়মিত যোগাযোগও রাখছেন। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজটি এখন মূলত করছেন সায়মা ওয়াজেদ।