অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর হঠাৎ করেই নিত্যপণ্যের বাজারে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দামে লেগেছে আগুন। চালের বাজারেও দেখা দিয়েছে অস্বস্তি। গরিব মানুষের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকায়, আর সরু চালের দাম ছুঁয়েছে ৯০ টাকা। সবজির দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অনেক সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকারও বেশি দামে। মসুর ডালের কেজি পৌঁছেছে ১৫০ টাকায়। পরিস্থিতি এমন যে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ডাল, ভাত আর সবজির যোগান এখন স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ডিমের ডজনের দাম সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা হওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এক পিস ডিম কেনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। মাছ-মাংস তো তাদের নাগালের বাইরে, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণিও উচ্চমূল্যের চাপে দিশেহারা। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস-কোনো কিছুর দামই আর আগের জায়গায় নেই। প্রতিদিনই পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। বাজারে গেলে চোখে পড়ে মানুষের অসহায়ত্ব। আগে যেখানে মাসের শুরুতেই পরিবারগুলো বড় বাজার করত, এখন তারা ভাগ করে সপ্তাহে কিনছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পণ্য নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সামলাতে গিয়ে মানুষের ভোজনের তালিকাও ছোট হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এখন দাওয়াত কিংবা মেহমানদারি বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। বাজেটের সংকোচন মানুষকে বাধ্য করছে আগেভাগেই ‘না’ বলতে। শুধু বাজার খরচ নয়, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াতসহ জীবনের প্রতিটি খাতে। একদিকে সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচে কাটছাঁট করছে, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের সাধ আর গরিবের চুলায় হাঁড়ি চাপানোও হয়ে পড়েছে কষ্টকর।
খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে শুক্রবার কথা বলে জানা গেছে, ৮ দিনের ব্যবধানে চালের দাম কিছুটা কমলেও এখনও তা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বিক্রেতাদের মতে, স্বর্ণা জাতের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৭-৬০ টাকা দরে, বিআর ২৮ ও পাইজাম ৬৫ টাকায়, মিনিকেট ৮০-৮৫ টাকায় এবং নাজিরশাইল ৮৫-৯০ টাকায়। সবজির বাজারেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। প্রতি কেজি বরবটি ১০০ টাকা, ঝিঙ্গা ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, শসা ১০০ টাকা, টমেটো ১৪০ টাকা, গোল বেগুন ১৪০ টাকা, লম্বা বেগুন ১০০ টাকা, গাজর ১৩০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৮০ টাকা-এমন আরও অনেক সবজি অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে। মাছ ও মুরগির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রুই, কাতলা, তেলাপিয়া ও পাঙাশের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা। খুচরা বাজারে রুই ও কাতলা ৩৫০-৪২০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০-২৬০ টাকা, পাঙাশ ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। নদীর চিংড়ি ১২০০ টাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকায়, সোনালি জাতের মুরগি ৩০০-৩২০ টাকায়। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়, খাসির মাংসের দাম সর্বোচ্চ ১২৫০ টাকা।
রাজধানীর নয়াবাজারে বাজার করতে আসা ভ্যানচালক মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, আধা ঘণ্টা ধরে বাজার ঘুরছি কিন্তু বুঝতে পারছি না কি কিনব আর কি রাখব। হাতে থাকা টাকা দিয়ে শুধু চাল-ডাল কিনলেই সব শেষ হয়ে যাবে। সবজির দাম শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায়। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থার এক উপদেষ্টা জানান, বছরের পর বছর কিছু ব্যবসায়ী একই কায়দায় মূল্য কারসাজি করে আসছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্থায়ী উদ্যোগ কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর হয়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকায় ভোক্তারা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারের উচিত বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি জোরদার করা।
অন্যদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল জানান, বাজারে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভোক্তার স্বার্থে অধিদপ্তরের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।